সাম্প্রতিক সময়ে একটি ভিডিও ও ছবি বেশ ভাইরাল হচ্ছে যেখানে একটি পাহাড়ি গ্রামকে দেখানো হচ্ছে।
দাবি করা হচ্ছে যে গ্রামটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় এবং মেঘ জমার সাধারণ উচ্চতা ২০০০ মিটার হওয়ায় গ্রামটিতে কখনো বৃষ্টি হয়নি।
কিছু গণমাধ্যম বলছে গ্রামটি ইয়েমেনের (Yemen) রাজধানী সানা’র (Sanaa) পশ্চিমে মানাখাহ (Manakhah) এর পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত আল-হুতাইব (Al-Hutayb) গ্রাম। আবার কিছু গণমাধ্যম দাবী করছে এটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশের (Arunachal Pradesh) পূর্ব সিয়াং (East Siang) জেলার পাসিঘাট (Pasighat) গ্রাম।
এই দাবি গুলো কী ফ্যাক্ট নাকি রিউমর ? চলুন তা যাচাই করা যাক
প্রথমে এটা জানা যাক যে ভাইরাল ছবি ও ভিডিওতে দেখানো গ্রামটি পাসিঘাট নাকি হুতাইব?
উভয়পক্ষই দাবি করে থাকে যে গ্রামটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২০০ মিটার উপরে অবস্থিত।
কিন্তু উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে পাসিঘাট গ্রামটি ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৫২ মিটার (৪৯৯ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত [¹]
এবং মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম আল-আরাবিয়া নিউজের তথ্যমতে হুতাইব গ্রামটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।[²]
এর থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে ছবি ও ভিডিওতে দেখানো গ্রামটি ইয়েমেনের হুতাইব গ্রাম।

অরুণাচলের পাসিঘাট
পাসিঘাট/হুতাইবে কি বৃষ্টি হয় না?
প্রথমে পাসিঘাট সম্পর্কে বলি, আন্তর্জাতিক আবহাওয়া রিপোর্টের তথ্যমতে, পাসিঘাটে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত হলেও প্রতিমাসেই বৃষ্টিপাত কমবেশি হয়ে থাকে সেখানে। পাসিঘাটে মাসিক গড় বৃষ্টিপাত হয় ১৬৩.৬৭ মিলিমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৫.৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ডিসেম্বরের দিকে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক অনেক কম হয়।[³]
তাই “পাসিঘাটে কখনো বৃষ্টি হয় না” এমন দাবি ভিত্তিহীন।
এবার আল-হুতাইব সম্পর্কে বলা যাক, হুতাইব গ্রাম সম্পর্কে আল-আরাবিয়া নিউজের করা রিপোর্টে “হুতাইব গ্রামে কখনো বৃষ্টি হয়নি” এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।[²]
এছাড়াও ইয়েমেনে হুতাইব গ্রাম ভ্রমণ করে এসে মেহলুম এস সাদ্রিওয়ালা নামের একজন ফটোজার্নালিস্ট পাকিস্তানের DAWN সংবাদপত্রে তার ইয়েমেন ভ্রমণ বর্ণনায় লিখেছে যে, হুতাইব গ্রামে অবস্থান কালে প্রতিদিন বৃষ্টি হতে দেখেছে সে।[⁴]

ইয়েমেনের হুতাইব গ্রাম
আন্তর্জাতিক আবহাওয়া রিপোর্টের তথ্যমতে, হুতাইবে প্রতিমাসেই কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। জুলাই ও আগষ্ট মাসে হুতাইবে ভারী বৃষ্টিপাত হয় এবং বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরের দিকে বৃষ্টিপাত অনেক কম হয়। হুতাইবের মাসিক গড় বৃষ্টিপাত ৪৩.৮৩ মিলিমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১.৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।[⁵]
এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, “হুতাইব গ্রামে কখনো বৃষ্টি হয় না” এই শীর্ষক দাবিটি একটি বিশুদ্ধ গুজব।
এবার পৃথিবীর প্রথম দশটি স্বল্প বৃষ্টিপাতের স্থান ও সেখানে বছরের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জানা যাক।
- ড্রাই ভ্যালি,অ্যান্টার্কটিকা (Dry Valleys, Antarctica): যেখানে একেবারেই বৃষ্টিপাত হয় না।
- আরিকা, চিলি (Arica, Chile): বছরে 0.761 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- আল-কুফরাহ, লিবিয়া (Al-Kufrah, Libya): বছরে 0.860 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- আসওয়ান, মিশর (Aswan, Egypt): বছরে 0.861 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- লুক্সর, মিশর (Luxor, Egypt): বছরে 0.862 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- ইকা, পেরু (Ica, Peru): বছরে 2.29 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- ওয়াদি হালফা, সুদান (Wadi Halfa, Sudan): বছরে 2.45 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- ইকিকে, চিলি (lquique,Chile)): বছরে 5.08 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- পেলিকান পয়েন্ট, নামিবিয়া (Pelican Point, Namibia): বছরে 8.13 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
- আউলেফ, আলজেরিয়া (Aoulef, Algeria): বছরে 12.19 মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।
তো দেখতেই পাচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম দশটি স্বল্প বৃষ্টিপাতের স্থানের মধ্যেও হুতাইব/পাসিঘাটের নাম নেই।[⁶]
এবার দাবির ২য় অংশটিতে বলা হয়েছে যে মেঘ জমার উচ্চতা ২০০০ মিটার হওয়ায় এর থেকে বেশি উচ্চতার কোনো স্থানে বৃষ্টি হয় না। চলুন দেখা যাক ২০০০ মিটারের বেশি উপরে মেঘ জমে কি না?
ভূপৃষ্ঠ থেকে মেঘের দূরত্ব/উচ্চতা অনুসারে মেঘকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
- নিম্নস্তরের মেঘ (Low Level Cloud): ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ মিটার বা ৬৫০০ ফুট উচ্চতার মধ্যে যে মেঘ জমা হয়ে থাকে সেগুলোকে নিম্ন স্তরের মেঘ বলে। কিউমুলাস (Cumulus), স্ট্র্যাটোকুমুলাস (Stratocumulus), স্ট্র্যাটাস (Stratus) হলো নিম্নস্তরের মেঘ।
- মধ্যস্তরের মেঘ (Middle Level Cloud): ভূপৃষ্ঠের ২০০০ মিটার উপর থেকে ৭০০০ মিটার বা ২৩০০০ ফুট উচ্চতায় যে মেঘ জমা থাকে সেগুলোকে মধ্যস্তরের মেঘ বলে। অল্টোকিউমুলাস (Altocumulus), অল্টোস্ট্রেটাস (Altostratus) হলো মধ্যস্তরের মেঘ।
- উচ্চস্তরের মেঘ (High Level Cloud): ভূপৃষ্ঠের ৯০০০ মিটার বা ২৯০০০ ফুট উপর থেকে ১২০০০ মিটার বা ৪০০০০ ফুট উচ্চতায় যে মেঘ জমা থাকে সেগুলোকে উচ্চস্তরের মেঘ বলে। সিরোকুমুলাস (Cirrocumulus), সিরোস্ট্রেটাস (Cirrostratus), সাইরাস (Cirrus) হলো উচ্চস্তরের মেঘ।
এই তিন প্রকারের বাইরেও এক প্রকার মেঘ আছে যেগুলোকে বহুস্তরের মেঘ (Multi Level Cloud) বলা হয়। একই সাথে দুই বা ততোধিক স্তরে অবস্থান করে বলে এগুলোকে বহুস্তরের মেঘ বলে। যেমন কুমুলোনিম্বাস (Cumulonimbus), নিম্বোস্ট্রাটাস (Nimbostratus)।
আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে, মেঘ শুধু ২০০০ মিটার উঁচুতেই জমা হয় না। ভূপৃষ্ঠ থকে প্রায় ১২০০০ মিটার উঁচুতেও মেঘ জমা হতে পারে।[⁷]
অতএব, সাম্প্রতিক ভাইরাল হওয়া গ্রামের ছবি ও ভিডিওতে বলা কথাগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং বিশুদ্ধ গুজব।