ও বেহুলা, আমি মরলে
আমায় নিয়ে ভাসাইও ভেলা…
নাহ, রূপকথার গল্প কিংবা প্রাচীন উপকথার মতো সবার জীবনে বেহুলা ভেলা ভাসাতে আসে না। বরং বর্তমানের যান্ত্রিক জীবনে মনের অস্থিরতায় জীবন নামক ভেলাটাকে লক্ষ্য অনুযায়ী ভাসিয়ে রাখতেই বেগ পেতে হয় বরং!
মন খারাপ ছিলো নিজেরো, হরহামেশাই থাকে সেটা কখনো অস্বীকার করি না। তবে আমার নিজের ভেতরের যা সমস্যা সেটাকে নিজ থেকে বুঝে নিয়েই সমস্যা উত্তোরণের জন্য সময় বের করি বরং। কিছু সময়ের জন্য নিজেকে নিজে সময় দিয়ে সমাধান করতে বসি অংক মেলানোর মতো।
আমার সাথে হয়তো অনেকেরই এই মনোযোগ ধরে রাখা নিয়ে এক বিশাল সমস্যায় পড়তে হয়, হয়তো কেউ নিজের লক্ষ্যমতো দৈনন্দিন কাজ বা পড়াশোনায় মনোযোগ রাখতে পারছেন না; তাদের জন্য কিছু দৈনন্দিন অভ্যাস ধারাবাহিকভাবে লিখতে চেষ্টা করছি। আশা করি কোনো বিষয়ে তারপরেও যদি বুঝতে কষ্ট হয় তাহলে আবার জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবেন।

প্রথমত,

মনোযোগ না থাকার জন্য মনের ভেতরটা সম্পর্কে নিজের বুঝতে পারাটা সবচেয়ে জরুরি। এই মনের ভেতরটা সম্পর্কে নিজে যখন পরিপূর্ণভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাবে তখনই আমরা আমাদের সমস্যার সমাধানের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাবো।
মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এই পদ্ধতিটিই সবচেয়ে প্রাচীন যাকে কেতাবি ভাষায় বলা হয় অন্তর্দর্শন পদ্ধতি বা Introspective Method. মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক পর্যায়ে এই পদ্ধতিটি মূল হিসাবে শুরু হলেও ব্যক্তিবিশেষের চিন্তা পরীক্ষণ ফলাফলে নিরপেক্ষতা প্রকাশ করে না বলে আস্তে আস্তে মনোবিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এই পদ্ধতির উপর নির্ভরতা কমে যায়।
সে যাই হোক, মনোবিজ্ঞান নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বরং আমাদের মনটা কিভাবে ভাবছে বা চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা তৈরি করছে সেটা আমরা এভাবে বের করতেই পারি। তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের যতটা সম্ভব নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা উচিত।
সেইজন্য আমরা দৈনন্দিন কিছু অভ্যাসে নিজের ভেতরকার সমস্যাটা নির্ণয় করে তারপর এর উপর আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টার বিভিন্ন ধাপগুলাতে আগাবো।

দ্বিতীয়ত,

মনোযোগ রাখতে না পারার ক্ষেত্রে আমি নিজের অন্তর্দর্শন বা অন্তনিরীক্ষণ করে বার বার ই যা বুঝি সেটা হলো কোনো কারণে আমার মন আমার দৈনন্দিন জীবন বা কাজের প্রতি সন্তুষ্ট না। সেইজন্যই তার স্বাভাবিক চাওয়াটা পূরণ না হওয়ায় মানসিকভাবে আমি অস্থির হয়ে থাকি। আর এই অস্থিরতাটাকে যতক্ষণ পর্যন্ত বশে আনা না যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার কাজে মনোযোগ ধরে রাখাটা কঠিন হবে।
এই তো গেলো আমার সমস্যাটাকে মোটামুটি ধরতে পারা। এরপর ও যদি কেউ মনে করেন আপনি অতটা মানসিকভাবে অস্থির না কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আপনার মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে তবুও ধাপে ধাপে নিজের নিয়মগুলা প্রতিদিনের কাজে অভ্যাস করতে শুরু করতে পারেন। কারণ দিনশেষে ওই “ভেতরের শান্তি” বা “inner peace” টাই সকল মানসিক কার্যক্রমের মূলে থাকে।
এবার মনোযোগ ধরে রাখার জার্ণিতে কি কি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে সেসবে আসি।
প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে আমার সমস্যাটি চিহ্নিত করার পর নিয়মিত কিছু অভ্যাস অনুশীলনের ব্যাপারে নিজের মানসিকতাকে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে দুই একদিন সময় নিয়ে হলেও আমরা যে অভ্যাসগুলো নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি তা যেন কষ্ট করে হলেও একাধারে এক মাস নিয়মিত চর্চা ধরে রাখতে পারি এমন লক্ষ্য সামনে রেখে শুরু করবো।
• মনকে শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে হবে প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে। একবার অস্থির হয়ে কোনো পদক্ষেপে ভুল হলো মানেই আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেলো; সবকিছু বাদ দিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলাম এই মানসিক চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণভাবে বাদ দিবো।
• পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং রাতে ঘুম না আসলেও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে চোখ রাখবো না। ডিভাইসগুলির ব্লু রে রশ্মি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। রাত ১২ টার পর অন্তত অনিচ্ছা স্বত্তেও ডিভাইসকে একপাশে রেখে অন্য পাশ ফিরে চোখ বুজে থাকবো ঘুমের আবেশ আনতে। অধৈর্য হওয়া যাবে না, চোখ খোলাও যাবে না। ঘরের পরিবেশ শীতল, শান্ত ও অন্ধকার হবে। প্রতিদিন একই সময়ে এভাবে ঘুমানোর প্রস্তুতি থাকবে, তাতে করে আমাদের “বায়োলজিকাল ক্লক” ঠিক থাকবে এবং পর্যাপ্ত ঘুমের সময় পাবো।
• ঘুমের সময়ে যাদের রাজ্যের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় কিংবা সারাদিন পর ওই সময়েই যাদের নানারকম কর্মকাণ্ডের চিন্তা মাথায় আসে তাদের বলছি; এই অভ্যাসটা হলো ওভার থিংকিং। যখন মস্তিষ্ক অলস সময় কাটায় বা বিশ্রাম নিতে উদ্দ্যোগী হয় তখন তাকে কর্মব্যস্ত করে রাখা৷ আর এই কাজটাই পরবর্তীতে সারাদিন আমাদের মনোযোগের ঘাটতিতে অবদান রাখে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ক্লান্তিতে প্রত্যেকটা কাজের মান কমিয়ে দেয়।
যখনই এমন চিন্তা আপনি পাশ ফিরে ঘুমাতে গিয়ে আবিষ্কার করেন তখনই আপনার নতুন আরেকটি অভ্যাস তৈরি করে নিতে হবে এই নতুন সমস্যাটিকে মোকাবেলা করার।
বিছানার পাশে একটি ছোট্ট টেবিল থাকলে সেখানে একটি ডায়েরি ও কলম রাখবেন সব সময়। টেবিল না থাকলেও রাখতে পারেন মাথার পাশেই যাতে প্রয়োজনে হাতের কাছে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে একটি বা দুইটি ডায়েরি হতে পারে।
একটি ডায়েরি হবে ঘুমানোর আগে আপনার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বর্ণনার জন্য। সারাদিন কি করলেন বা করলেন না, ভবিষ্যতে কিরকম ভাবে আগাতে চান; এক কথায় আপনার মাথায় ঘুমানোর আগ মুহুর্তে যা আসে তাই ই। এতে করে আপনার সব চিন্তা একসাথে প্রকাশ করে ফেললেন ডায়েরিতে আর আপনার বার বার এসব নিয়ে চিন্তা করার প্রবণতাটা কমে যাবে।
আরেকটি ডায়রি থাকবে আপনার আত্নসন্তুষ্টি প্রকাশের জন্য। আমরা হয়ত সাধারণভাবে বুঝতে পারি না প্রতিদিনের কাজে ছোট ছোট কাজের স্বীকৃতি বা সন্তুষ্টি প্রকাশ আমাদের মানসিক প্রশান্তি কতটা বাড়িয়ে দিতে পারে। কমপক্ষে তিনটি কাজ বা পদক্ষেপ সম্পর্কে আপনার ঐদিনের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে নম্বর দিয়ে টীকা আকারে লিখে ফেলতে পারেন। দুইটি ডায়রী ঝামেলার মনে হলে একটি ডায়রীতেই করতে পারেন দুটি কাজ।
আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার, ঘুম আসে না বা ঘুম হয় না কেন এই নিয়ে চিন্তা করে রাতের ঘুম হারানোর কোনো অর্থ নেই। এই বিষয়টি নিয়ে অযথা চিন্তা করাটাও আপনার ঘুম না হওয়ার আর ওভারথিংকিং এর কারণ।